ভারতবর্ষের রহস্যময় এই মন্দিরে পূজা হয় রাক্ষসীর !

ভগবানের দর্শন পেতে সবাই যায় মন্দিরে। কিন্তু যদি আপনারা কখনও হিমাচল প্রদেশের মানালিতে বেড়াতে যান তাহলে সেখানে অবস্থিত মন্দিরে দেখতে পাবেন এক অবিশ্বাস দৃশ্য।কারন  হিমাচল প্রদেশের এই মন্দিরে কোন ভগবান নয় পূজা করা হয় এক রাক্ষসীর। এই রাক্ষসী অন্য কেউ নয় মহাভারতের হিড়িম্বা রাক্ষসী। ভাবলেই অবাক লাগে যে একজন রাক্ষসী হয়ে হিড়িম্বা সেখানে পূজিতা হন। কিন্তু কেন?

হিমাচলপ্রদেশের শহর মানালি। ছুটি দিনে ছবির মতো সুন্দর শৈলশহরটিতে ঘুরতে আসেন বহু মানুষ। শুধু দেশের মানুষজনই নয় এখানে ঘুরতে আসেন বিদেশীরাও। হিমাচলের মানালি শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত  হিড়িম্বা মন্দির। হিড়িম্বা যার কথা বর্ণিত রয়েছে মহাভারতে। মহাভারতের কাহিনী অনুসারে বারণাবতে যখন দুর্যোধন পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার প্রচেষ্টা করলেন। তখন তাদেরকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছিলেন বিদুর।  ওই সময় এক বনে তারা প্রবেশ করেছিলেন, যেখানে রাক্ষস হিড়িম্ব এবং তার বোন হিড়িম্বার বাস করতেন। জঙ্গলে মানুষ প্রবেশ করছে খবর পেলেন হিড়িম্ব তার বোন হিড়িম্বাকে পাঠিয়েছিলেন তাদের সন্ধানে। এদিকে এক সুন্দরী রমণীর  রূপ ধারণ করলেন হিড়িম্বা রাক্ষসী। তবে মধ্যম পাণ্ডব ভীমকে দেখে প্রেমে পড়ে গেলেন। তাকে সে বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন।। এদিকে বোনের দেরি হচ্ছে দেখে সেখানে উপস্থিত হলেন হিড়িম্ব। তার বোনের এরূপ আচরণ করতে দেখে হিড়িম্ব তাকে মারতে উদ্যত হলে ভীম তাঁকে বধ করলেন।

তবে  ভীম রাজি ছিলেন না হিড়িম্বাকে কোনোভাবেই বিবাহ করতে। তখন হিড়িম্বা আত্মহত্যা করতে যায়। এতে কুন্তি ভীমকে অনুরোধ করে হিড়িম্বাকে বিবাহ করতে। মায়ের আদেশে হিড়িম্বাকে বিবাহ করে মধ্যম পাণ্ডব ভীম। পরে এক বিদ্বান পুত্রসন্তানও হয় ভীম ও হিড়িম্বার। যার নাম ঘটোৎকচ।

তবে বিয়ের পূর্বে শর্ত ছিল যে তাদের একটাই সন্তান হওয়ার পর ভীম হিড়িম্বাকে ত্যাগ করবেন। কথিত আছে যে,  ঘটোৎকচের জন্মানোর পর সেখান থেকে চলে যান ভীম। পুত্রসন্তানকে নিয়ে হিড়িম্বা মানালির ওই জঙ্গলেই গভীর তপস্যায় মগ্ন হন। ঘটোৎকচকে বড় করে তোলেন নিজের হাতে ।

চারতলা হিড়িম্বা এই মন্দিরটি দেখতে অনেকটা বৌদ্ধ প্যাগোডার মতো। এর উচ্চতা ২৪ মিটার। এই মন্দিরটি আনুমানিক প্রায় চারশো বছরের পুরানো। ষোড়শ শতকে রাজা বাহাদুর সিং এর আমলে নির্মিত হয়েছিল বর্তমান মন্দিরটি। এই মন্দিরে হিড়িম্বার পায়ের ছাপ রয়েছে। এবং ভীম ও ঘটোৎকচের মন্দিরও পাশেই রয়েছে। অসংখ্য চমরি গাই রয়েছে মন্দির চত্বরে ।

একবার আগুনে পুড়ে হয়েছিল কাঠের মূল মন্দিরটি। তবে এর  থেকেও একটি রোহমর্ষক গল্প প্রচলিত রয়েছে। প্রথম এই মন্দিরটি যে শিল্পী বানিয়েছিলেন তিনি এটিকে  এত অপূর্ব বানিয়েছিলেন যে তিনি যাতে  এই রকমের আর কোনো মন্দির বানাতে না পারেন সেই জন্য রাজা ওই শিল্পীর ডান হাত কেটে নেন। তবে ওই  শিল্পীটায় জেদি ছিলেন যে তিনি বাম হাত দিয়ে চাম্বায় বানান ত্রিলোকনাথের মন্দির।

আনুমানিক ১৫৩৩ সালে মানালির হিড়িম্বা মন্দিরটি  তৈরি হয়েছিল। কালো রঙের এক বিশাল পাথর রয়েছে এই মন্দিরের ভিতরে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন যে হিড়িম্বা ওই কালো পাথরের নিচেই ধ্যানে বসতেন। গোটা মন্দির জুড়েই রয়েছে  অসাধারণ কাঠের কারুকার্য। হিন্দু মন্দিরে বৌদ্ধ প্যাগোডার শৈলী যেন ক্রস কালচারের এক জীবন্ত দলিল।

বিভিন্ন পশুর শিঙ দিয়ে সাজানো রয়েছে গোটা মন্দিরটি। এবং এক বিশাল আয়তনের পায়ের ছাপ রয়েছে। স্থানীয়রা মনে করেন যে  সেই পায়ের ছাপ স্বয়ং মা হিড়িম্বার নাকি। চারিদিকে থাকা পাইন এবং দেবদারু গাছের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে পড়া আলো সৃষ্টি করে এক মায়াবী আলো-আঁধারি পরিবেশ। নবমী বা নবরাত্রির দিনে যখন সারা দেশজুড়ে মা দুর্গার আরাধনায় মাতেন তখন এক রাক্ষসীর আরাধনায় মেতে ওঠে মানালি।

হিড়িম্বা মন্দির থেকে কিছুটা দূরে গেলে দেখা যাবে আরও একটি মন্দির, যা আকৃতিতে তুলনামূলক ছোট। ওই মন্দিরটি হল হিড়িম্বা এবং ভীমের সন্তান ঘটোৎকচের। ভারতীয় রাজ্য হিমাচল প্রদেশের মানুষেরা  ঘটোৎকচকে দেবতা হিসাবে পূজা করে। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য হিমাচল প্রদেশের মানালির মনোমুগ্ধকর হিল স্টেশনের ধুংগারি  গ্রামে অবস্থিত, যা  হিড়িম্বা মন্দির থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে অবস্থিত। মহাভারত অনুসারে  ঘটোৎকচ  কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় পাণ্ডব পক্ষ থেকে যুদ্ধ করে  মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সমগ্র ভারতে, উত্তর ভারতের রাজ্য হিমাচল প্রদেশই সম্ভবত একমাত্র রাজ্য যেখানে ঘটোৎকচকে দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়। অসংখ্য চমরি গাইয়ের মন্দির চত্বরে দেখা মিলবে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন যে হিড়িম্বা মা আজও তাদের আপদে বিপদে রক্ষা করে চলেছেন, এবং রক্ষা করছেন গোটা অঞ্চলকে। তাই মানালিতে অবস্থিত এই মন্দিরটি এক অদ্ভুত মন্দির যেখানে অন্যান্য মন্দিরে ভগবান পূজা করা হয় সেখানে এই মন্দিরে পূজা করা হয় এক রাক্ষসীর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *