দুর্গা পূজায় কুমারী পূজা কেন করা হয়? কি বলছে পুরাণ!

কুমারী পূজা যা দুর্গা পূজার অন্যতম অঙ্গ হিসাবে মানা হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মের বহু শাস্ত্রগ্রন্থে এই পূজার নির্দেশনা থাকলেও শুরু হয়েছিল মাত্র ১০০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দের হাত ধরে বেলুড় মঠে।এরপর থেকেই অষ্টমীর মহাতিথিতে ভারত ও বাংলাদেশের রামকৃষ্ণ মিশনসহ বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে এই কুমারী পূজা হয়ে থাকে।মতান্তরে মহানবমী তিথিতেও কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে। কুমারি পূজা কি? কেন করা হয় কুমারি পূজা? এই ধরনের নানান প্রশ্ন মনের মধ্যে বাসা বাঁধে। যার উত্তর রয়েছে পুরানে। কুমারি পূজা নিয়ে কি বলছে পুরান?  

বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মার যখন রামের দুর্গাপূজা করার নির্দেশ দেন তখন শরৎকাল, দক্ষিণায়ণ।অর্থাৎ  সেই সময় দেবতাদের নিদ্রার সময়। এইজন্য  ব্রহ্মা স্তব করে জাগরিত করলেন দেবীকে। তখন দেবী কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বললেন যে , বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে।  মর্ত্যে এসে দেবতারা দেখলেন যে, এক দুর্গম স্থানে একটি তপ্তকাঞ্চন বর্ণা বালিকা ঘুমিয়ে রয়েছে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার রাশির মধ্যে। ব্রহ্মা তখন বুঝলেন যে , এই বালিকাই আসলে জগজ্জননী দুর্গা। তিনি বোধন- স্তব করে জাগরিত করলেন তাঁকে। ব্রহ্মার স্তবে জাগরিতা দেবী বালিকামূর্তি ত্যাগ করে ধারন করলেন চণ্ডিকামূর্তি।

অন্যমতে অনুসারে,  কুমারী পূজার উদ্ভব হয়েছিল  কোলাসুরকে বধ করার মাধ্যমে।  এক সময় কোলাসুর নামের এক অসুর স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বিপন্ন দেবগণ শরণাপন্ন হন মহাকালীর কাছে। সকল দেবগণের অনুরোধে কোলাসুরকে বধ করতে দেবী কুমারীরূপে পুনর্জন্ম করেন এবং বধ করেন কোলাসুরকে। আর সেই থেকে মর্ত্যে শুরু হয়েছিল কুমারী পূজার প্রচলন।

আবার অনেকে বলে থাকেন যে, মুনিঋষিরা সেকালে প্রকৃতিকে পুজো করতেন কুমারীপুজোর মাধ্যমে । প্রকৃতি অর্থাৎ নারী। তাঁরা কুমারীদের মধ্যে দেখতে পেতেন  সেই প্রকৃতিরই আর এক রূপ। তাঁরা মনে করতেন যে ঈশ্বর রয়েছে মানুষের মধ্যেই। বিশেষ করে যাদের মন সৎ এবং নিষ্পাপ তাদের মধ্যেই ঈশ্বরের প্রকট সবথেকে বেশি। এই সমস্ত গুণগুলি কুমারীদের মধ্যে থাকে মনে করেই  এই পুজোর দেবী হিসেবে তাদের বেছে নেওয়া হয়।

তন্ত্রসার অনুসারে, কুমারী পূজার জন্য  উপযুক্ত  “১ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত বালিকারা;  কিন্তু তাদের অবশ্যই ঋতুমতি হওয়া চলবে না।” মেরুতন্ত্রে বলা আছে, “ ব্রাহ্মণ কন্যা সর্বকামনা সিদ্ধির জন্য, ক্ষত্রিয় কন্যা যশোলাভের জন্য, বৈশ্য কন্যা ধনলাভের জন্য এবং পুত্র লাভের জন্য শূদ্রকূল জাত কন্যা কুমারী পূজার জন্য যোগ্য।” এই জাতি বা বর্ণ নির্ধারিত হয় গুণ ও কর্ম অনুসারেই। এইজন্যই প্রচলিত শাস্ত্র অনুসারে, ব্রাহ্মণ কন্যাকেই  সর্ব মঙ্গলের জন্য  দেবী জ্ঞানে পূজা করা করে বিভিন্ন মিশন ও মন্দিরগুলোতে। সমস্ত নারীর মধ্যই  দেবীশক্তি বিরাজিত রয়েছে। কিন্তু  মা দুর্গা  কুমারী রূপেই বিশেষভাবে প্রকটিত হয়েছিলেন। এই জন্য, দেবীজ্ঞানে কুমারী রূপে নারীকে সন্মান জানানো হয় যার  বাস্তব উদাহরন হচ্ছে “কুমারী পূজা”। এইজন্য পূজারীরা কুমারী মাতৃরূপে ঈশ্বরকে আরাধনা করেন। মাতৃরূপে ঈশ্বরেরই একটি আরাধনা হল কুমারী পূজা।

আবার মহাদেব যোগিনী শাস্ত্রে বলেছেন,

শতকোটি জিহ্বায় কুমারী পূজার ফল ব্যক্ত করতে পারব না।

শুদ্ধতার প্রতীক হওয়ায় কুমারীকন্যাকে মাতৃরূপে ঈশ্বরের আরাধনার জন্য নির্বাচন করা হয়। অষ্টমী বা নবমীতে কুমারী পূজা করা হয়। 

দেবী পুরাণে সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে কুমারী পুজোর। শাস্ত্র মতে, কুমারী পূজার জন্য উপযুক্ত  “১ থেকে ১৬ বছরের অজাতপুষ্প সুলক্ষণা কুমারীরা তারই উল্লেখ রয়েছে। শুধুমাত্র অবিবাহিত ব্রাহ্মণ কন্যাদেরই নয় অবিবাহিত অন্য গোত্রের কন্যাকেও পুজো করার উল্লেখ রয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর প্রকাশ। নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় কুমারী পুজোর মাধ্যমে। ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে কুমারীকে পুজো করেন। সেই প্রতি অষ্টমী তিথিতে  প্রতিবছর মাহা ধুমধাম করে পুজো করার এই প্রথা চলে আসছে। এছাড়াও কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা এবং অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষে এবং কামাখ্যাদি শক্তিক্ষেত্রেও।

মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী দেবী মন্দিরে ও কন্যাকুমারীতেও মহা ধুমধাম করে কুমারী পুজো হয়। কথিত আছে যে, কুমারীপুজো ছাড়া হোম-যজ্ঞ করেও দুর্গাপুজোর সম্পূর্ণ ফল পাওয়া যায় না।। নতুন বস্ত্র, ফুলের মালা, কপালে সিঁদুর, তিলক, মাথায় মুকুট এবং পায়ে আলতা পরিয়ে কুমারীকে সাজানো হয়   কুমারীপুজোর আগে।

কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত রয়েছে যোগিনীতন্য, কুলার্ণবতন্য, দেবীপুরাণ, স্তোত্র, কবচ, সহস্রনাম, তন্যসার, প্রাণতোষিণী, পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে। বর্ণনানুসারে  কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই কুমারী পূজায়। যে-কোন কুমারীই দেবীজ্ঞানে পূজনীয়। তবে  সর্বত্র প্রচলিত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই।  বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়  এই সকল কুমারীদের। 

  • এক বছরের কন্যা — সন্ধ্যা
  • দুই বছরের কন্যা — সরস্বতী
  • তিন বছরের কন্যা — ত্রিধামূর্তি
  • চার বছরের কন্যা — কালিকা
  • পাঁচ বছরের কন্যা — সুভগা
  • ছয় বছরের কন্যা — উমা
  • সাত বছরের কন্যা — মালিনী
  • আট বছরের কন্যা — কুষ্ঠিকা
  • নয় বছরের কন্যা — কালসন্দর্ভা
  • দশ বছরের কন্যা — অপরাজিতা
  • এগারো বছরের কন্যা — রূদ্রাণী
  • বারো বছরের কন্যা — ভৈরবী
  • তেরো বছরের কন্যা — মহালপ্তী
  • চৌদ্দ বছরের কন্যা — পীঠনাযি়কা
  • পনেরো বছরের কন্যা — ক্ষেত্রজ্ঞা
  • ষোলো বছরের কন্যা — অন্নদা বা অম্বিকা

হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে এই এক একটি নাম জগত মাতার স্বরূপের এক একটি গুণ প্রকাশ করে। সাধারণত ৫ থেকে ৭ বছরের কুমারীকন্যাকে নির্বাচিত করা হয় কুমারী পূজার জন্য ।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। এইজন্য পূজারীরা কুমারী মাতৃরূপে ঈশ্বরকে আরাধনা করেন।

 তৃতীয় বা শেষ জন্মে কি রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন  নারায়নের এই দ্বারপাল?

নিউজ ডেস্কঃ বৈকুণ্ঠে  নারায়ণের দুই দ্বারপালের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিজয় যিনি এক ব্রাহ্মণ এর কাছ থেকে অভিশপ্ত হয়েছিলেন।অভিশাপ অনুযায়ী তাঁকে তিনবার মর্ত্যলোকে জন্ম করতে হবে এবং তাঁকে সেই অভিশাপ্ত থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণু। সেই অনুসারে তৃতীয়বার জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিজয়। কিন্তু তৃতীয় বা শেষ জন্মে কি রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন নারায়নের এই দ্বারপাল? কে ছিলেন এবং কিভাবেই বা মুক্তি লাভ করেছিলেন তাঁর এই জন্ম থেকে?       

চেদী রাজ্যের দক্ষিণে অবস্থিত করূষ রাজ্যের রাজা বৃদ্ধশর্মা এবং বসুদেব ও কুন্তীর ভগিনী শ্রুতদেবার পুত্র ছিলেন দন্তবক্র৷  করূষ রাজ্যের রাজবংশের সন্তান হওয়ার জন্য বাকা কৌরূষ্য  নামেও পরিচিত ছিলেন  দন্তবক্র। তার পিতা মাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান ছিলেন  দন্তবক্র। বাকিরা ছিলেন, নীল, বহন্ত, বসুদন এবং বিদুরথ৷ জন্মের পর থেকেই তার দাঁতের পাটি বাঁকা থাকার কারনে তার নাম রাখা হয়েছিল “দন্তবক্র”৷

আসলে দন্তবক্র এবং তার মাসতুতো ভাই শিশুপাল পূর্ব জন্মে ছিলেন বৈকুণ্ঠে  নারায়ণের দুই দ্বারপাল জয় এবং  বিজয়। যারা একবার তাদের ঔদ্ধত্যের কারনে  এক ব্রাহ্মণ এর কাছ থেকে অভিশপ্ত হতে হয়েছিলেন। তিনি অভিশাপ দিয়েছিলেন যে তাদের মর্ত্যলােকে তিন জন্ম নাস্তিক আর নিষ্ঠুর হয়ে কাটাতে হবে । প্রচন্ড দেব বিরােধিতা করে অসুর মনােভাব নিয়ে অত্যাচার করে  কাটাতে হবে তাদের  ওই তিনটি জন্মই। তখন তারা এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পথ জানতে চান ভগবান বিষ্ণু কাছে। ভগবান বিষ্ণু তখন তাদেরকে বলেন যে তিনি স্বয়ং নিজে মর্তে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে আনবেন ।দন্তবক্র  এবং শিশুপালের এটি ছিল মর্ত্যলোকে তৃতীয় ও শেষ জন্ম বলে মনে করা হয়৷ 

হিন্দুদের মহাকাব্য মহাভারত অনুসারে,  করূষদেশের রাজপুত্র দন্তবক্র দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভাতে উপস্থিত ছিলেন ৷ তাঁর পিতা বৃদ্ধশর্মা সন্যাস গ্রহণ করলে তিনি রাজসিংহাসনে বসেন৷ সেই সময় পূর্ব ভারতে জরাসন্ধ মগধ অঞ্চল থেকে তাঁর আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেন ৷ দন্তবক্র নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এবং নিজের রাজ্য বাঁচাতে মিত্রতাপত্র পাঠিয়ে ছিলেন জরাসন্ধের কাছে। যা তিনি গ্রহণ করে নিয়েছিলেন৷ এরপরে তাঁর সাথে  রাজকুমারী ভদ্রা ও বিশালার সাথে বিবাহ ঠিক হলে তাদের দুজনকেই অপহরণ করেন চৈদ্য শিশুপাল। যাতে তিনি অত্যন্ত রুষ্ট হয়েছিলেন৷

পদ্মপুরাণের অনুসারে,  দন্তবক্র ছিলেন চৈদ্য রাজকুলেরই সন্তান ৷ তাঁর রাজ্যাভিষেকের পরে তিনি জরাসন্ধ ছাড়াও সন্ধি করেছিলেন কংস, শল্ব ও পুণ্ড্রকের সহিত ৷ 

রাজসূয় যজ্ঞের সময় যুধিষ্ঠির দক্ষিণদেশে সহদেবকে পাঠিয়েছিলেন। সহদেব করূষ রাজ্য দখল করতে অগ্রসর হন৷ এরপর দন্তবক্রের সাথে  যুদ্ধের হয় সহদেব ও তার সৈন্যদলের। ওই যুদ্ধে সহদেব  তাঁকে পরাস্ত করেন এবং বাধ্য করেন ইন্দ্রপ্রস্থতে রাজকর দিতে৷ পরে আবার সহদেব  করূষের চুক্তবদ্ধ রাজা হিসাবে দন্তবক্রকে নিয়োজিত করেছিলেন৷ তবে তিনি তাদের আমন্ত্রন গ্রহন করলেও ইন্দ্রপ্রস্থে রাজসূয় যজ্ঞে উপস্থিত ছিলেন না। কারন  তার মিত্র জরাসন্ধকে পাণ্ডবরা  হত্যা করেছিলেন বলে ৷শল্বরাজার মিত্র  ছিলেন  শিশুপাল৷ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সভাস্থলেই কৃষ্ণ তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে  শিরোচ্ছেদ করেন  শিশুপালের৷ এতে  কৃৃষ্ণকে আক্রমণ করেন  মিত্রবদ্ধ শল্বরাজ ৷ কিন্তু কৃষ্ণের হাতে শল্ব নিহত হয়৷ কৃষ্ণ তাঁর মিত্র শল্বরাজকে হত্যা করার কারনে তিনি অত্যন্ত ক্রোধিত হয়ে গদা নিয়ে হাজির হন কৃৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা নগরীতে৷ তিনি কৃষ্ণকে বলেন যে তিনি তার ভ্রাতা হলেও তাঁর মিত্রের মৃত্যুর জন্য তাঁকে শাস্তি দিতে এসেছেন দ্বারকায় তিনি৷ এরপর দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণ এবং দন্তবক্রের মধ্যে গদা যুদ্ধে শুরু হয়। দন্তবক্র তার গদা দিয়ে কৃষ্ণর মাথায় আঘাত করলে কৃৃষ্ণের ইশারায় তার কৌমোদকীর ধারালো অংশ দ্বারা দন্তবক্রের হৃদয় বিদারিত করলে তার হৃৎপিণ্ড দ্বিখণ্ডিত হয় এবং মৃত্যু হয় দন্তবক্রের৷ আর এইভাবে  শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা দন্তবক্র মর্ত্যলোকে তাঁর শেষ জন্ম থেকে মুক্তি লাভ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.