লাদাখের ইতিহাস ও সীমান্ত নিয়ে চীন এবং ভারতবর্ষের বিতর্ক কয়েকশো বছর পুরনো। কেন এই ঝামেলা মেটার নয়?
রাজেশ রায়:– লাদাখ নিয়ে ভারত ও চীনের ঝামেলা প্রায়ই হয়। কয়েক বছর আগেই গালওয়ান ভ্যালিতে ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। অনেকেরই ধারনা ১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধের পর থেকে বোধহয় লাদাখ নিয়ে দুই দেশের ঝামেলা শুরু হয়েছে কিন্তু তা নয়, লাদাখের ইতিহাস জানলে বোঝা যাবে এই ঝামেলা বহু পুরোনো।
লাদাখ ভারতের উত্তরাংশে অবস্থিত একটি ট্রান্স হিমালিয়ান অঞ্চল। তবে অন্য হিমালিয়ান অঞ্চলের মত এখানে সবুজের কোন সমারহ নেই কারন এখানে বৃষ্টিপাত হয়না বললেই চলে। যার জন্য এখানের আবহওয়া খুবই শুকনো ও রুক্ষ। এটি পার্বত্য অঞ্চল হলেও দেখতে অনেকটা মরুভূমির মতই লাগে। শীতকালে এখানে প্রবল তুষারপাত হয় এবং গ্রীষ্মকালে সেগুলো গলে গিয়ে নদী তৈরি হয় এবং সেই নদীর তীরেই বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট জনপদ রয়েছে এখানে। পাহাড়ের উপর জনসংখ্যা খুবই কম এখানে, মূলত নদীর তীরেই জনসংখ্যা বেশী। লাদাখ শব্দের অর্থ উঁচু পার্বত্য পথ। লাদাখের গড় উচ্চতা ১১০০০ ফুট, তবে এখানের উঁচু পার্বত্য অঞ্চলের উচ্চতা প্রায় ১৬০০০ ফুট যার জন্য এই এলাকা সবসময় সুরক্ষিত কারন এত উচ্চতা অতিক্রম করা শীতকালে কোনওভাবেই সম্ভব নয়, গ্রীষ্মকালে অতিক্রম করা যায় খুব কষ্ট করে। লাদাখ আগে জম্মু কাশ্মীরের অংশ ছিল, তবে সম্প্রতি জম্মু কাশ্মীর রাজ্য কে ভেঙে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল তৈরি করা হয়েছে জম্মু কাশ্মীর ও লাদাখ। লাদাখে দুটি জেলা রয়েছে কার্গিল ও লে। লাদাখের রাজধানী লে। লাদাখের পশ্চিমে রয়েছে জম্মু কাশ্মীর, উত্তরে রয়েছে পাকিস্তানের গিলগিট বালতিস্তান, উত্তর পূর্বে রয়েছে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ, পূর্বে রয়েছে তিব্বত ও দক্ষিনে রয়েছে হিমাচল প্রদেশ রাজ্য। লাদাখ ও তিব্বত উপত্যকা প্রাচীন কাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্যিক পথ ছিল। কারন এই জায়গা গুলো রেশম পথের পুরো মাঝামাঝি অবস্থিত ছিল প্রায়। পাশমিনা উল সহ গুরুত্বপূর্ণ বানিজ্য তিব্বত থেকে লাদাখ হয়ে কাশ্মীরে আসত। লাদাখকে মধ্য এশিয়ার প্রবেশপথ বলা হয়।
আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে পঞ্চম শতকের দিকে তিব্বত খুব শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল। লাদাখ, গিলগিট বালতিস্তান সহ পুরো মধ্য এশিয়া তিব্বত সাম্রাজ্য ভুক্ত ছিল। কিন্তু সব বড় সাম্রাজ্যেরই পতন হয়, ঠিক তেমনি ৮৪২ সালে তিব্বতের রাজ লাংদারমাকে হত্যা করা হয়, তারপরেই এই সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। পরবর্তী একশো বছরে এই সাম্রাজ্যে ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে যায় ও অনেক নতুন নতুন রাজ্য তৈরি হয়। ৯৩০ সালে এই এলাকায় মারিউল নামে একটি সাম্রাজ্য তৈরি হয়। বলা হয় তিব্বত রাজপরিবারের এক সদস্যই এই সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল। আজকের লাদাখ এবং তিব্বতের প্রাচীন রাজধানী লাসা সহ পশ্চিম তিব্বত নিয়ে গঠিত হয়েছিল এই মারিউল সাম্রাজ্য, এই কারনে প্রাচীনকালে লাদাখকে মারিউলও বলা হত। একই ভাষা, একই ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাসের কারনে লাদাখের উপর তিব্বতের অনেকটা প্রভাব ছিল। প্রায় এক হাজার বছর ধরে তিব্বতের লাদাখের উপর প্রভাব ছিল। মারিউল সাম্রাজ্যও একসময় দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তখন লাদাখে অনেক ছোট ছোট রাজার শাসন শুরু হয়। এরপর ১৪৬০ সালে লাদাখে নামগিয়াল নামে আরও একটি বড় সাম্রাজ্য তৈরি হয় যারা ছোট ছোট রাজাদের একত্রিত করে একটি বড় সাম্রাজ্য গঠন করে। ১৮৪২ অবধি প্রায় ৪০০ বছর এরা লাদাখে রাজত্ব করে। লে শহরে নামগিয়ালরা নয় তলা একটি বিশাল প্রাসাদ তৈরি করেছিল যা আজও বর্তমান। লে শহরের প্রত্যেক কোন থেকে এটা দেখা যায় এবং চারশো বছর পরও এটা অক্ষত।
ষোলো শতকে নামগিয়ালদের শাসন কালে উত্তর ভারতে মুঘল শাসন শুরু হয়। ১৫৮৬ সালে আকবর কাশ্মীর দখল করে। তবে মুঘলরা লাদাখ আক্রমন করেনি বরং এখানে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছিল। কারন লাদাখের প্রকৃতির জন্য এখানে সেনা পাঠানো খুবই কষ্টকর। ১৬৭৯-৮৪ সাল অবধি লাদাখের সাথে তিব্বতের যুদ্ধ হয় তখন মুঘল সেনা লাদাখের হয়ে যুদ্ধ করেছিল। আঠারো শতক আসতে আসতে মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে সেসময় পাঞ্জাবে শিখদের ক্ষমতা বাড়তে থাকে। মহারাজ রনজিত সিং ১৮১৯ সালে কাশ্মীর বিজয় করে এবং ওনার পরবর্তী লক্ষ হয় লাদাখ বিজয়। এজন্য জম্মুর শিখ শাসক গুলাব সিং জামওয়ালকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। গুলাব সিং তার সেনাপতি জোরোয়ার সিংকে দায়িত্ব দেয়। জোরোয়ার সিং তার ৪০০০ সেনা নিয়ে লাদাখে উপস্থিত হয়। কার্গিল থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে শঙ্কু নামক জায়গায় দুই পক্ষের যুদ্ধ হয়। নামগিয়ালদের সেনা শিখ দের থেকে বেশী ছিল, প্রায় ৫০০০ সেনা ছিল তাদের। কিন্তু তাও ১৮৩৪ সালের ১৬ আগস্ট শিখদের কাছে পরাস্ত হয় তারা। এভাবে লাদাখে নামগিয়াল সাম্রাজ্যের পতন হয়। লাদাখে শুরু হয় ডোগরা শাসন যা শিখদের অধীনে ছিল। যুদ্ধে জেতার পরও জোরোয়ার সিং খুশী ছিল না তার লক্ষ্য ছিল শিখ সাম্রাজ্য আরও বিস্তার ঘটানো সেজন্য পশ্চিম তিব্বত দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় জোরোয়ার সিং। তিব্বত তখন চীনের অধীনে ছিল। চীনের কুইং রাজবংশ এখানে শাসন করত। জোরোয়ার সিং এর সেনা কুইং এর সেনার মধ্যে মানস সরোবরের কাছে যুদ্ধ হয় ১৮৪১ সালের মে মাসে, একে সিনো শিখ যুদ্ধ বলা হয়। যুদ্ধে শিখরা পরাজিত হয় এবং জোরোয়ার সিং মারা যায়। কুইং সেনারা এখানেই থেমে থাকে না তারা লাসা পর্যন্ত চলে আসে কিন্তু সেখানে ডোগরাদের সাথে যুদ্ধে কুইংরা পরাজিত হয়। এরপর ১৮৪২ সালে উভয়পক্ষের মধ্যে চুশুলের সন্ধি হয় যাতে বলা হয় উভয় পক্ষ যুদ্ধের পূর্ববর্তী জায়গায় ফিরে যাবে এবং কেউ কাউকে কোনদিন আক্রমন করবেনা। এর চারবছর পর অ্যাংলো শিখ যুদ্ধের পর শিখ সাম্রাজ্য ব্রিটিশদের অধীনে চলে আসে। গুলাব সিং ১৮৫০ সালে ব্রিটিশদের থেকে ৭৫ লাখ টাকার বিনিময়ে কাশ্মীর কিনে নেয় এবং সেখানকার রাজা ঘোষনা করে নিজেকে।
১৮৫০ সালের পর এই প্রথম ব্রিটিশরা লাদাখে পৌঁছায়। ব্রিটিশরা লাদাখে অনেক গবেষনা দল পাঠিয়েছিল সেখানকরা ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে জানার জন্য ও ম্যাপ তৈরি করার জন্য। কিন্তু লাদাখের উচু পার্বত্য অঞ্চলের কারনে কোথায় তিব্বত শেষ হচ্ছে কিংবা কোথায় লাদাখ শুরু হচ্ছে তা নির্ধারন করা সম্ভব হয়নি। সেইসময় মধ্য এশিয়ায় ব্রিটিশ ও রাশিয়ার মধ্যে একপ্রকার অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল কে কতটা জায়গা দখল করবে সে বিষয়ে সেজন্য ব্রিটিশরা কাশ্মীর ও লাদাখ কে রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে বাফার জায়গা হিসাবে ব্যাবহার করেছিল যার অর্থ দুটি বড় সাম্রাজ্যের মধ্যে ফাঁকা জায়গা। তবে ব্রিটিশরা লাদাখের সীমানা নির্ধারনের চেষ্টা করেছিল। ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশরা প্রথম চেষ্টা করে এবং লাদাখের সীমানা নির্ধারনের জন্য একটি রেখা তৈরি করা হয় যাকে বলে জনসন লাইন। ভারত আজও এই লাইন মানে এবং ভারতের ম্যাপে এটি রয়েছে। ১৮৭৩ সালে দ্বিতীয়বার ব্রিটিশরা আবারও একটি লাইন তৈরি করে কিন্তু একে ভারত চীন কেউ মানে না। ১৮৯৭ সালে তৃতীয় বারের মতো আর একটি লাইন টানা তৈরি করা হয় যার নাম ম্যাকর্টনি ম্যাকডোনাল লাইন। কিন্তু এই লাইনে আকসাই চীনকে তিব্বতের অংশ হিসাবে দেখানো হয়। লাদাখের ভূ-প্রকৃতির কারনে আজ এত উন্নত প্রযুক্তি থাকা সত্বেও ভারত চীন দুই পক্ষের কাছেই সেনা রাখা সমস্যা হয়ে পড়ে, তখনকার দিনে তো সেনা রাখা আরও সমস্যা ছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয় এবং ১৯৪৯ সালে পিপলস রিপাবলিক অফ চীন গঠন হয়। লাদাখ ভারতের অংশ হয় এবং ১৯৫৯ সালে চীন জোর করে তিব্বত দখল করে। চীনের দাবি পুরো লাদাখ তাদের, তারা কোন লাইন মানে না কিন্তু ভারত জনসন লাইন অনুযায়ী লাদাখ তাদের বলে। চীন প্রাচীন তিব্বতের হিসাব অনুযায়ী মারিউল সাম্রাজ্যের সীমানা হিসাবে লাদাখকে দাবি করে কিন্তু ভারত এই দাবীকে উড়িয়ে দিয়েছে। যদিও ব্রিটিশরা ১৯১৪ সালে সিমলায় তিব্বতিদের সাথে এই ব্যাপারে চুক্তি করেছিল কিন্তু চীনের দাবি তিব্বতিদের নিজের থেকে সিদ্ধান্ত নেবার কোন অধিকার নেই কারন তিব্বত চীনের অংশ। ১৯৫৬ সালে চীন তার জিনজিয়াং প্রদেশ ও তিব্বতকে সংযুক্ত করবার জন্য গোপনে ভারতী অংশ আকসাই চীন হয়ে একটি রাস্তা তৈরি করে। ভারত এই ব্যাপারে জানতই না ১৯৫৮ সালে চীন যখন তাদের ম্যাপ প্রকাশ করে তখন ভারত জানতে পারে। এব্যাপারে জহরলাল নেহেরুর সরকারকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন এই এলাকায় কোন মানুষ বাস করেনা, এখানে একটা ঘাসও জন্মায় না।জহরলাল নেহেরুর এই বিতর্কিত বক্তব্য বিশ্বে এটা প্রমান করেছিল এই জায়গা সম্পর্কে ভারতের কোন আগ্রহ নেই এবং ভারত চীনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে ভয় পায়। জহরলাল নেহেরুর এই বিতর্কিত ভাষন বিশ্বে ভারতের সম্মান হানি করেছে। ১৯৬২ সালের ভারত চীন যুদ্ধের পর চীন ম্যাকডোনাল লাইন পার করে আরও এগিয়ে এসেছিল। সেই থেকেই এই এলাকায় লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি তৈরি হয় যার কাছেই গালওয়ান উপত্যকা, এখানে ভারত চীন সেনার সংঘর্ষ হয়েছিল। ২০১৯ সালে আর্টিকেল ৩৭০ তুলে দিয়ে লাদাখকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল ঘোষনা করারা মাধ্যমে চীনকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে। লাদাখকে রক্ষা করার জন্য ভারতবর্ষ সবসময় প্রস্তত।